বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ,
বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ,

প্রাচীন যুগে বাংলা সাহিত্য: ইতিহাস ও যুগবিভাজন 2024

আজ থেকে হাজার বছরের বেশি সময় আগে সূচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের পথচলা। উক্ত সময়ে বাংলা সাহিত্য তার গতি ও বৈশিষ্ট্য একই রকম ভাবে ধরে রাখতে পারেনি। সময়ের আবর্তেনে সাহিত্যের ধরণে পরিবর্তন এসেছে। ভিন্নতার এই ধরণ অনুসারে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

মূলত দুটি ঘটনা কে কেন্দ্রে করেই বাংলা সাহিত্যের এই বিভাজন, আর তা হলো ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়; এবং ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা। এর মধ্য দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত ও বাংলা গদ্যের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সূচনা হয়। প্রথমটি মধ্যযুগের, এবং অপরটি আধুনিক যুগের সূচনাকাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের ভেতর ভাষার পার্থক্য ছাড়া অন্য কিছু তেমন একটা লক্ষ করা যায় না।

প্র. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস কবে থেকে শুরু হয়?

উ. চর্যাপদের কাল থেকে।

প্র. বাংলা সাহিত্যের যুগকে প্রধানত কতভাগে ভাগ করা যায়?

উ. তিন ভাগে যথাঃ

১। প্রাচীন যুগঃ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত । ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ।

২। মধ্যযুগঃ ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

৩। আধুনিক যুগঃ ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান ।

# দীনেশচন্দ্র সেন রচিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রচেষ্টা। তাঁর মতে বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাজন:

১. হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ (৮০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ),

২. গৌড়ীয় যুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ,

৩. চৈতন্যসাহিত্য বা নবদ্বীপের যুগ,

৪. সংস্কার যুগ,

৫. কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ বা নবদ্বীপের দ্বিতীয় যুগ।

# ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) গ্রন্থে যুগ বিভাগ করেছেন নিম্নোক্তরূপে:

১. প্রাচীন যুগ বা মুসলমানপূর্ব যুগ (৯৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ),

২. তুর্কি বিজয়ের যুগ (১২০০-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ),

৩. আদি মধ্যযুগ বা প্রাকচৈতন্য যুগ (১৩০০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ), ৪.অন্ত্য মধ্যযুগ (১৫০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) [চৈতন্যযুগ বা বৈষ্ণব সাহিত্য যুগ (১৫০০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং নবাবী আমল (১৭০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)]

৫. আধুনিক যুগ (১৮০০- বর্তমান)।

প্র. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন কোনটি?

উ. চর্যাচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি বা চর্যাপদ।

প্র. মধ্যযুগকে আবার কয়ভাগে ভাগ করা হয়?

উ. তিন ভাগে । যথাঃ

১। প্রাকচৈতন্য যুগঃ (১২০১-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ)

২। চৈতন্য যুগঃ (১৫০১-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ)

৩। চৈতন্য পরবর্তী যুগঃ (১৬০১-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)

প্র. মধ্যযুগের কাব্যের প্রধান ধারা কয়টি?

উ. ৪টি। যথা: ক. মঙ্গলকাব্য, খ. বৈষ্ণব পদাবলি, গ. রোমান্সধর্মী প্রণয়োপাখ্যান, ঘ. অনুবাদ সাহিত্য।

প্র. সাহিত্যে আধুনিক যুগ কবে শুরু হয়?

উ. ১৮০১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক যুগ শুরু হয় ১৮৬০ সালের দিকে মাইকেল মধুসূদনের সদর্প আবির্ভাবের মাধ্যমে।

প্র. প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কী?

উ. প্রাচীনযুগে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও ধর্মনির্ভরতা। মধ্যযুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ধর্মনির্ভরতা।

প্র. আধুনিক যুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কী?

উ. আত্মচেতনা, জাতীয়তাবোধ ও মানবতার জয়জয়কার ।

বাংলা সাহিত্যঃ  প্রাচীন যুগ

চর্যাপদ

প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। এর ভাষা ও বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য এবং এর কবিরা ছিলেন বৌদ্ধ সাধক। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। এ সময়ের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠী কেন্দ্রিকতা ও ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। সামাজিক জীবনের চিন্তা চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ম তাই সাহিত্য ধর্মকে কেন্দ্রিয় বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে এসেছে।

প্র. প্রাচীন যুগ কোন সময়কালকে ধরা হয়? উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, ৯৫০-১২০০ খ্রি.। ড. সুকুমার সেনের মতে, ৯০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ ।

প্র. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন কোনটি?২৭/২১/১৭তম বিসিএস লিখিত।

উ. চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি বা চর্যাপদ । প্র. চর্যাপদ কী ও কারা এগুলো রচনা করেন? /২৪/২০তম বিসিএস লিখিত] উ. চর্যাপদ গানের সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা। চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা এ গানের সংকলন বা সাধন সংগীতের সাহায্যে কোনটি চর্য (আচরণীয়) আর কোনটি অ- চর্য (অনাচরণীয়) তা বিনিশ্চয় (নির্ণয়) করা যেতে পারে ।

প্র. চর্যাপদ নেপালে পাওয়ার কারণ কী?

উ. ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেন রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত সেন সময়কালের কতিপয় হিন্দু ব্রাহ্মণ বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন চালায়। আবার, ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলায় আগমন ঘটলে মুসলিম তুর্কিদের আক্রমণের ভয়ে বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ প্রাণের ভয়ে পুঁথিপত্র নিয়ে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে পালিয়ে যায়। একারণেই চর্যাপদ নেপালে পাওয়া যায়।

প্র. চর্যাপদ আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে কী জান?

উ. ১৮৮২ সালে ‘বিবিধার্থ পত্রিকার সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্র Sanskrit Buddhist Literature in Nepal E নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধতান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন।

রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা, বিহার ও আসাম অঞ্চলের পুঁথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর। তিনি তৃতীয়বারের (প্রথমবার- ১৮৯৭, দ্বিতীয়বার-১৮৯৮) প্রচেষ্টায় ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে নতুন কিছু পুঁথির সন্ধান পান যা ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’, ‘ডাকার্ণব’, ‘সরহপাদের দোহা’ ও ‘কৃষ্ণপাদের দোহা’ নামে পরিচিত।

এর মধ্যে ‘চর্যাপদ’ বাংলা ভাষায় এবং বাকী তিনটি অপভ্রংশ ভাষায় রচিত। ১৯১৫ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপাল থেকে প্রাপ্ত তালপাতার পুঁথির একটি তালিকা A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS. Belonging to the Durbar Library, Nepal নামে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে এটি তাঁর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয় ।

প্র. চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয় কবে ও কোথা থেকে? [৪৪/৩৪/২৮/২৭তম বিসিএস লিখিত]

উ. ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার করেন।

প্র. চর্যাপদ কে আবিষ্কার করেন? ২৭তম বিসিএস লিখিত]

উ. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)। মহামহোপাধ্যায় তাঁর উপাধি। প্র. চর্যাপদ কবে ও কোথা থেকে প্রকাশিত হয়? [২৭তম বিসিএস লিখিত] উ. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২৩ ব.) কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’, ‘ডাকার্ণব’, ‘সরহপাদের দোহা’ ও ‘কৃষ্ণপাদের দোহা” গ্রন্থের সম্মিলনে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয়।

প্র. চর্যাপদ কবে রচিত হয়?

উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ৯৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। ড. সুকুমার সেনের মতে, ৯০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ। প্র. চর্যাপদ রচনার সময় কোন রাজারা ক্ষমতায় ছিল? উ. চর্যাপদ রচনার সময়কালে বাংলায় পাল রাজারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা প্রায় চারশত বছর বাংলা শাসন করেছে।

প্র. চর্যাপদের কবি/পদকর্তা কতজন?

উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ২৩ জন । ড. সুকুমার সেনের মতে, ২৪ জন ।

চর্যাপদের কবিদের / পদকর্তাদের নাম:

আর্যদেবপা, কঙ্কণপা, কম্বলাম্বরপা, কাহ্নপা, কুক্কুরীপা, গুগুরীপা, চাটিলপা, জয়নন্দীপা, ঢেণ্ডণপা, ডোম্বীপা, তান্তী পা, তাড়কপা, দারিকপা, ধৰ্ম্মপা, বিরূপা, বীণাপা, ভাদেপা, ভুসুকুপা, মহীণ্ডাপা, লাড়িডোম্বীপা, লুইপা, শবরপা, শান্তিপা, সরহপা ।

প্র. চর্যাপদের মোট পদ কতটি ও কয়টি পাওয়া গেছে?

উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫০টি এবং প্রাপ্ত পদ সাড়ে ছেচল্লিশটি। ড. সুকুমার সেনের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের মতে, পদ সংখ্যা ৫১টি।

প্র. চর্যাপদের কোন কোন পদ পাওয়া যায়নি।

উ. ২৩ নং অর্ধেক, ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ ।

প্র. যেসব পদ পাওয়া যায়নি সেগুলোর রচয়িতা কে ?

উ. ২৩- ভুসুকুপা, ২৪- কাহ্নপা, ২৫- তান্তীপা, ৪৮- কুক্কুরীপা ।

প্র. চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদের রচয়িতা কে?

উ. কাহ্নপা। তিনি ১৩টি পদ রচনা করেন। যথা: ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪ (পাওয়া যায় নি), ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫। চর্যার পদকর্তাদের নামের শেষে সম্মানসূচক ‘পা’ যুক্ত হয়েছে। চর্যায় যারা পদ রচনা করেছেন তাদের ১১. প্রত্যেককে ‘মহাসিদ্ধ’ বলা হয়ে থাকে।

প্র. চর্যাপদের প্রথম পদের রচয়িতা কে?

উ. লুইপা। তিনি ২টি পদ রচনা করেন। যথাঃ ১, ২৯। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, তিনি শবরপার ছাত্র ছিলেন। লুইপাকে আদি চর্যাকার হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

প্র. চর্যাপদের প্রথম পদটি কী?

উ. কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল / চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ।

প্র. চর্যাপদ কোন ছন্দে লেখা?

উ. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।

প্র. কোন পণ্ডিত চর্যাপদের পদগুলোকে টীকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন?

উ. মুনিদত্ত । [মুনিদত্ত ১১ নং পদের ব্যাখ্যা প্রদান করেননি।

প্র. চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ কে আবিষ্কার করেন?

উ. চর্যাপদ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন কীর্তিচন্দ্র। ১৯৩৮ সালে প্রবোধচন্দ্র বাগচী এটি আবিষ্কার করেন।

প্র. চর্যাপদের অন্যান্য পদকর্তাগণ কে কতটি পদ রচনা করেন?

উ. ভুসুকু পা (বাঙালি কবি) ৮ টি, সরহ পা 8 টি, কুক্কুরী পা (মহিলা কবি) ৩ টি, লুই পা, শবর পা, শান্তি পা ২ টি করে এবং অবশিষ্ট পদকর্তাগণ ১টি করে পদ রচনা করেন। লাড়ীডোম্বী পা’র নাম নাম পাওয়া গেলেও তাঁর কোন পদ পাওয়া যায়নি।

প্র. চর্যাপদের প্রবাদ বাক্য কয়টি ও কী কী?

উ. ৬টি। যথাঃ

  1.  অপণা মাংসে হরিণা বৈরী (৬নং পদ- ভুসুকুপা)। অর্থ: হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু।
  2. হাথে রে কাঙ্কাণ মা লোউ দাপণ (৩২নং পদ- সরহপা)। অর্থ: হাতের কাঁকন দেখার জন্য দর্পণ প্রয়োজন হয় না।
  3. হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী (৩৩নং পদ- ঢেণ্ডণপা)। অর্থ: হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকরা এসে ভীড় করে ।
  4. দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামায় (৩৩নং পদ- ঢেণ্ডাপা)। অর্থ: দোহন করা দুধ কি বাটে প্রবেশ করানো যায়?
  5. বর সুণ গোহালী কিমো দুঠ বলন্দে (৩৯নং পদ- সরহপা)। অর্থ: দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল ।
  6. অণ চাহন্তে আণ বিণঠা (৪৪নং পদ- কঙ্কণপা) অর্থ: অন্য চাহিতে, অন্য বিনষ্ট ।

প্র. প্রাচীনতম ও আধুনিকতম চর্যাকার কে?

উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, প্রাচীনতম শবর পা (৬৮০- ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং আধুনিকতম ভুসুকুপা। শবরপা, ভুসুকুপা ও লুইপা বাঙালি কবি হিসেবে পরিচিত।

প্র. কাহ্নপার পরিচয় দাও। (১৩/১০তম বিসিএস লিখিত]

উ. চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদের রচয়িতা কাহ্নপা। তিনি ১৩টি পদ রচনা করেন। কাহ্নপা সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধযোগী। তিনি ধর্মশাস্ত্র ও সংগীত শাস্ত্র উভয় বিষয়েই দক্ষ ছিলেন। তাঁর পদগুলোতে নিপুণ কবিত্বশক্তি প্রকাশের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।

প্র. চর্যাপদের ভাষা কোনটি?

উ. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষা । এর ভাষার নাম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘বঙ্গকামরূপী’ । এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।

প্র. সন্ধ্যা ভাষা কী? এ ভাষায় রচিত সাহিত্য সম্পর্কে লিখুন। (৪০তম, ৩৮তম ও ৩২তম বিসিএস লিখিত]

উ. যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি, যে ভাষার অর্থ একাধিক অর্থাৎ আলো-আঁধারের মতো, সে ভাষাকে পণ্ডিতগণ সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাপদ’ এ ভাষায় রচিত। ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাপদ’ গানের সংকলন বা সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। সন্ধ্যা ভাষা সম্পর্কে চর্যাপদের আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, ‘আলো-আঁধারির ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না’।

প্র. চর্যাপদের ভাষা নিয়ে কে আলোচনা করেন?

উ. চর্যাপদের ভাষা নিয়ে কে আলোচনা করেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর  The Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে।

প্র. চর্যাপদের ধর্মমত নিয়ে কে আলোচনা করেন?

উ. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে।

প্র. চর্যাপদের ধর্মমত সম্পর্কে ধারণা দিন। [২৯তম বিসিএস লিখিত]

উ. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একটি মাত্র নিদর্শন পাওয়া যায় তা হলো চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। চর্যাগীতি বা চর্যাপদ গানের/কবিতার সংকলন বা  সাধন সংগীত যা বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচনা করেন। এতে বিধৃত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বকথা।

এগুলো মূলত মহাজ্ঞান ধর্মশাখার অন্তর্গত সহজযান ধর্মশাখার সাধনসংগীত। বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা কালক্রমে যেসব উপশাখায় বিভক্ত হয়েছিল তারই বজ্রযানের সাধনপ্রণালী ও তত্ত্ব চর্যাপদে বিধৃত। ‘মহাসুখরূপ নির্বাণ লাভ’ হলো চর্যার প্রধান তত্ত্ব। এ সম্পর্কে চর্যাকার ভুসুকুপা বলেছেন, ‘সহজানন্দ মহাসুহ লীলে’। চর্যাপদ বৌদ্ধধর্মের মূলগত ভাবনার অনুসারী হলেও এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ।

প্র. চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের ব্যাখ্যা দাও। (৪৩/৩৫/ ২৮-তম বিসিএস লিখিত)

উ. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাগীতিকোষ’ বা ‘চর্যাগীতি’ বা ‘চর্যাপদ’। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার (রয়েল লাইব্রেরি) থেকে এটি আবিষ্কার করেন। শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে ‘চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’, ‘ডাকার্ণব’ ও ‘সরহপাদের দোহা’ ও ‘কৃষ্ণপাদের দোহা’ গ্রন্থের সম্মিলন ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয় ।

এটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক শুরু হয় এর ভাষা নিয়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘চর্যাপদ’ গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কারক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ তাঁর এ দাবিকে সমর্থন করেন।

১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার History of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগীতির ভাষাকে প্রাচীন বাংলা বলতে অস্বীকার করেন। এছাড়াও হিন্দি, অসমিয়া, উড়িষ্যা প্রভৃতি ভাষাবিদরা নিজ নিজ ভাষার আদি নিদর্শন বলে দাবি করেন।

১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) (১৯২৬) গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ এবং চর্যার কবিদের নাম, পদ্মা নদীর নামের উল্লেখ (ভুসুকুপার ৪৯ নং পদে ‘পউয়া খাল’) বিশ্লেষণ করে এর ভাষাকে প্রাচীন বাংলার আদি নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন ।

১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর  ‘Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha’ গ্রন্থে পাওয়া যায়  তিনি সুনীতিকুমারের মতকে সমর্থন করেন। তিনি এই ভাষার নাম দেন বঙ্গকামরূপী।

তবুও  সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করে বলা যায় যে, এটি সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষায় এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত।

প্র. নবচর্যাপদ কী?

উ. ‘নবচর্যাপদ’ চর্যাপদের অনুরূপ রচনা। শশীভূষণ দাশগুপ্ত ১৯৬৩ সালে নেপাল ও তরাইভূমি থেকে ২৫০টি পদ আবিষ্কার ও সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ১০০টি পদ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে সেটি তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৯৮৮ সালে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নবচর্যাপদ’ নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯৮টি পদ সংকলন করে প্রকাশ করেন।

প্র. নতুন চর্যাপদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ।

উ. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভাষাবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মল শাহেদ গবেষণার জন্য নতুন করে কিছু সাহিত্যিক নিদর্শনের আবির্ভাব করেন যার নাম “নতুন চর্যাপদ”।

এখানে মূলত বজ্রযানী দেবদেবীর আরাধনার গীত সংকলিত হয়েছে। এর পদগুলোতে তান্ত্রিক নানা দেবদেবীর রূপসৌন্দর্য, মুখ ও বাহুর বর্ণনা, তাঁদের আসন, মুদ্রা ও দেহভঙ্গি, তাঁদের আভরণ ও আয়ুধ ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য ও বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে।

এটি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলায় প্রকাশিত হয় এবং উৎসর্গ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। ২০০৮ সালে ড. শাহেদ কাঠমুন্ডু ও আশেপাশের বিভিন্ন বজ্রযানী মন্দিরে পুঁথি সংগ্রহ করতে গিয়ে রত্নকাজী বজ্রাচার্যের নিকট থেকে নতুন চর্যাপদের দুটি সংকলিত পুস্তক সংগ্রহ করেন।

এ পুস্তক দুটির পদগুলো ছিলো নেওয়ারিমিশ্রিত দেবনাগরী অক্ষরে মুদ্রিত। অষ্টম থেকে বিশ শতকে লিখা সাহিত্য নতুন চর্যাপদে সংকলিত হয়েছে। সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় যে চর্যাপদ শুধু প্রাচীন সাহিত্যের নিদর্শন নয়, এই রচনা মধ্য যুগেও বিদ্যমান ছিলো।

নতুন চর্যাপদে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ৩৩৫টি পদ  সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও রাহুল সাংকৃত্যায়ন থেকে ২০টি, শশিভূষণ দাশগুপ্ত থেকে ২১টি এবং জগন্নাথ উপাধ্যায় থেকে ৩৭টি পদ সংকলিত করা হয়েছে। সে হিসেবে এ গ্রন্থে সংকলিত নতুন চর্যাপদের মোট সংখ্যা ৪১৩টি ।

নতুন চর্যাপদের ভূমিকা অংশটি চার ভাগে বিভক্ত । প্রথম অংশ → ‘নতুন চর্যার সংগ্রহ ও চর্যাকার পরিচয়।’ দ্বিতীয় অংশ → ‘নতুন চর্যায় বজ্রযানী দেবদেবী।’ তৃতীয় অংশ → ‘নতুন চর্যার আঙ্গিক, ভাষা ও ভূগোল।’ চতুর্থ অংশ → ‘চর্যাপদ ও নতুন চর্যা’ ।

Check Also

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ

আঠারো শতকের শেষার্ধে ও উনিশ শতকের শুরুতে রাষ্ট্রিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া সাহিত্যে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *